'Echo' শব্দের ভালো বাংলা হতে পারে 'প্রতিধ্বনি'। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়া ছাত্রদের আঁক কষতে হয়-
'২০ মিটার দূর থেকে জনাব অমুক ১২০০ hz কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি করলে তিনি প্রতিধ্বনি শুনবেন কি না?'
তবে মজার ব্যাপার হলো Echo'র আদিমতম পরিচয় হল এটি কোনো শব্দ নয়, নয় কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা। Echo হলো একজন মানুষের নাম। ইংরেজি আরো অনেক শব্দের মতো Echo শব্দের উৎপত্তি গ্রিক মিথলজি বা পৌরাণিক কাহিনী থেকে।
গ্রিক পুরান মতে ইকো ছিলো এক দূরন্ত বালিকা যে সারাক্ষণ কথা বলত। 'বাচাল মেয়েছেলে' আরকি। একবার সে জংগলে বসে তার সখীদের সাথে বসে গাল-গল্প করছিল। অন্যদিকে আবার ঘটছে আরেক ঘটনা। দেবরাজ জিউসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জিউসকে খুজতে দেবরানি হেরা স্বয়ং বেরিয়ে পড়লেন। বেশ কিছুদিন ধরে একটা সন্দেহ তার মাথায় এসেছে। আজ মিনশে কে হাতে-নাতে ধরবেন বলে দেবরানি হেরা জঙ্গলের দিকে চললেন। পথে যাকেই পান বলে যান রাজামশাইকে দেখলে আমাকে ডেকে দিও তো। তো হাঁটতে হাঁটতে তিনি ইকোর দেখা পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন 'দেবরাজ জিউসকে দেখেচিস?'। ইকোর উত্তর ,'মাননীয়া, আপনার আগমনে আমরা সবাই খুশি। কতদিন পর মানব মন্ডলে আপনার আগমন। হেরা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, 'হ্যাঁ সে তো জানি। যেটা জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দে'। ইকো একটু হেসে উত্তর দেয়, 'আজকের আকাশটা কীরকম নীল দেখেছেন। ফুলগুলোও যেন আজ বিশেষভাবে সৌরভ ছড়াচ্ছে। এসবই আপনার সম্মানে'। হেরার মেজাজ তখন সপ্তমে চড়েছে। কণ্ঠটাকেও সপ্তমে চড়ালেন তিনি। 'ওরে বেল্লিক মেয়ে, আমি তোকে অভিশাপ দিলাম। আজ থেকে তুই নিজ থেকে কোনো কথা বলতে পারবিনা। অন্যকেউ তোর সামনে কিছু বললে তুই কেবল সেই কথাই রিপিট করতে পারবি।' ব্যাস। হয়ে গেলো। ইকো তখন কান্নাকাটিতে ব্যস্ত। হেরা আবার চেঁচিয়ে বললেন, 'ভাগ এখান থেকে'। ইকো জবাব দিলো,'ভাগ এখান থেকে'।
ইকোর দুঃসময় শুরু হলো তখন থেকে। সে বনে-বাঁদরে ঘুরে বেড়ায়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কে তুমি? সে উত্তর দেয় কে তুমি? এভাবে চলতে লাগলো অনেক দিন। একদিন জঙ্গলে বসে সে তার আশু ভবিষ্যতের কথা ভাবছিল। এমন সময় দূরে পায়ে হাঁটা রাস্তার দিকে তাকিয়ে তার চোখ স্থির হয়ে গেল। পা টিপেটিপে এগিয়ে আসছে অনিন্দ্য সুন্দর এক তরুন। দেখেইতো বাংলা সিনেমার মতো প্রথম দর্শনে কোথায় যেন নায়ক-নায়িকারা পড়ে যায় না? ওইখানে পড়ল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। লজ্জায় সে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তরুন যেভাবে এসেছিল, শিকারের ধান্ধায় সেভাবেই চলে গেলো। ইকোকে দেখতে পেল না।
এইবারে আমাদের হিরো সম্পর্কে কিছু বলা যাক। তার নাম নারসিসাস। তার ফুলবাবুর মতো দেহখানা কত তরুনির হৃদয়ে যে ঝর তুলেছে তার হিসাব করার জন্য কেরানি রাখতে হয়। কিন্তু কেউই তেমন সুবিধা করতে পারেননি। পারবেন কিভাবে? নারসিসাস যে কিছুতেই কাউকে তার মনের মতো পান না। যেই প্রেয়সী হতে চায়, তার খুঁতগুলোই সবার আগে তার চোখে পড়ে। 'মেয়েটার নাকটা একটু বোঁচা না?', 'এই মেয়ের গায়ের রঙতো তেমন উজ্জ্বল না' কিংবা 'এই মেয়ের সাইজ ট্যাবলেটের মতো কেন?' ইত্যাদি হাজার রকমের অজুহাতে শহরের সবকটা মেয়েকে সে বাতিল করে দিয়েছে। ইকোর মতো তারও যে দিনকাল ভালো যাচ্ছে না সেকথা তো পরিষ্কার।
যাইহোক, কোথায় যেন ছিলাম? ও হ্যাঁ, নারসিসাসকে দেখে আর সবার মতো ইকোর হৃদয়ও বিগলিত হয়ে গেল। দিন নেই রাত নেই, ইকো কেবল নারসিসাসের কথা ভাবে। কি করে নারসিসাসকে সব কথা বলবে। রবিন্দ্রনাথের মতো একটু রসিয়ে রসিয়ে বললে 'সুখের মতো ব্যথা' । সমস্যা হলো ইকোতো নিজ থেকে কোনো কথাই বলতে পারে না। নারসিসাস ওকে মধুময় কিছু বললে সে কথাই সে কেবল ফিরিয়ে দিতে পারবে। ইকো তবু হাল ছাড়ল না। শারলক হোমসের মতো সে নারসিসাস সম্পর্কে নানা খবর সংগ্রহ করল। সে কি খেতে পছন্দ করে, কোথায় অবসর কাটায়, এমনকি এ পর্যন্ত কতজন নারীর হৃদয় সে ভঙ্গ করেছে সে সংখ্যাটা পর্যন্ত। (পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে মেয়ে কথা বলতে পারে না সে কিভাবে এগুলো করবে? উত্তরটা হলো - যুক্তি খুঁজতে যাবেন না। এটাই পৌরাণিক কাহিনীর মূলকথা। ) নারসিসাসের পিছনে সে ঝানু স্পাইয়ের মতো লেগে রইলো। একদিন নারসিসাস মহাশয় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে একটা নদীর পাশে বসলেন একটু জিরিয়ে নিবেন বলে। অবধারিতভাবে ইকো লুকিয়ে লুকিয়ে তার পিছে পিছে আসছিল। সেও একটা পাথরের আড়ালে বসে পড়ল। নারসিসাস খানিক হাঁপিয়ে পানি খাওয়ার জন্য নদীর দিকে হাত বাড়াবে এমন সময় নদীর স্থির পানিতে তারই প্রতিবিম্ব দেখে সে বিস্মিত হলো নাকি অভিভূত হলো, নিজেই ঠাহর করতে পারল না। এমন সুগঠিত চেহারা আর দেবতার মতো দেহ সে কস্মিনকালে দেখে নি। কয়েক মুহূর্ত নড়তে পারল না সে। একসময় অস্ফুট কন্ঠে তার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমি এতদিন তোমার অপেক্ষায়ই ছিলাম। তোমাকেই আমার চাই।' পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয়া ইকোর অবস্থা তখন গাছ থেকে পড়া তুলোর মতো। যেন এক মাতাল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দিগন্তের বাইরে। সে ভাবেনি তার উপস্থিতিতেই নারসিসাস এতো মুগ্ধ হয়ে যাবে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে সেই বাক্যগুলোই প্রতিধ্বনিত করল - 'আমি এতদিন তোমার অপেক্ষায়ই ছিলাম। তোমাকেই আমার চাই।' ওদিকে নিজেকে দেখে মোহিত হয়ে যাওয়া নারসিসাস নিজের প্রতিবিম্বকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য পানিতে হাত দিয়েই ইকোর কথা গুলো শুনতে পেল। পিছনে ফিরে তাকিয়ে ইকোকে সেখানে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হলো বটে কিন্তু এরচেয়েও কত দৃষ্টিনন্দন জিনিস তার হাতের নাগালে আছে, ভেবে সামনের দিকে মুখ ফেরাল। নারসিসাস মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দেখে ইকোর পৃথিবীতে অমানিশা নেমে আসলো। এসবই ঘটলো নিমিখের মধ্যে। নারসিসাস মুখ ফিরিয়ে তার প্রতিবিম্ব দেখতে পারলো না। তার হাতের ছুঁয়ায় যে জলতরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভেসে গেছে প্রতিবিম্ব। নারসিসাস তারস্বরে এক চিৎকার করে পানিতে লাফ দিলো। সেটা দেখে পিছন থেকে ইকো আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠল। নারসিসাসের সলিল সমাধি হল।
ইকো আবার হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এ ক'দিনের উত্তেজনার সমাপ্তি যে এভাবে হবে সে ভাবতেই পারে নি। সে মানব সংসার ত্যাগ করে পৃথিবীর পাহাড়-প্রান্তরে পাড়ি জমালো। আজও কেউ খোলা প্রান্তরে বা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বললে ইকো সে কথা ফিরিয়ে দেয়।
গল্পের এপিলগে আরো কিছু বলা যেতে পারে। যে জায়গা থেকে নারসিসাস লাফ দিয়েছিল সেখানে এক অতীব সুন্দর ফুলগাছের জন্ম হলো। গাছটা নদীর দিকে মুখ করে বাড়তে লাগলো। যেন কাঁধ উঁচিয়ে নিজেকে দেখছে। ফুলের নাম 'নারসিসিস'।
প্রথমেই বলেছিলাম ইংরেজি অনেক শব্দ গ্রিক মিথলজি দ্বারা প্রভাবিত। শুধু শব্দ নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক টার্মও গ্রিক মিথলজি প্রসূত। নারসিসাসের এই যে নিজের প্রতি মুগ্ধতা সেটাকে আজ সাইকোলজির ভাষায় বলা হয় 'নারসিসিজম'। সহজ বাংলায় বললে নিজের প্রতি মুগ্ধ থাকার প্রবনতা। এইকারনেই ফেসবুকসহ পৃথিবীর তাবৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এতো সফল। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর প্রত্যেক সদস্যই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে নারসিসিস্ট। তা সে রাজা-গজাই হোক আর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ভেগাবন্ড। এ নিয়ে বিস্তর কথা আছে। অন্য একদিন বলা যাবে।
আমাদের দেশের রুই-কাতলারা উপরের দুই চরিত্র দ্বারা ভারি প্রভাবিত। দলের আলফা সদস্য যা বলেন তাই অন্যরা হাসিমুখে প্রতিধ্বনিত করেন। দলের আলফা সদস্য নিজের কাজ আর দেশের বন্যা সৃষ্টিকারী উন্নয়নের জোয়ার নিয়ে অত্যন্ত বিমোহিত। আমরা সেই রুই কাতলার দিঘীতে সামান্য শৈবাল মাত্র। তবে আমরাও যেহেতু মানব সমাজের সদস্য, আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন? কিছু একটা করে ফেললে সেটা কয়েক হাজারগুণ বাড়িয়ে ফেসবুকে সচিত্র প্রতিবেদন লিখি। বিবর্ধিত কন্ঠে আমাদের একফোটা শিশিরের গুণগান গাই।(এটা মোটেও কোনো পলিটিক্যাল স্যাটায়ার জাতিয় কিছু নয়। নিখাদ শিশুতোষ রচনা)
Comments
Post a Comment